Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

উপজেলা প্রশাসনের পটভূমি

 

উপজেলা মোট আয়তন ২১৪.৪০বর্গকিলোমিটার। ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশের ‍উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা কিশোরগঞ্জের মাঝামাঝি স্থানে চব্বিশ ডিগ্রী বিশ মিনিট, চব্বিশ ডিগ্রী ত্রিশ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ ও নব্বই ডিগ্রী পঞ্চাশ মিনিট, একান্নব্বই ডিগ্রী পনের মিনিট, পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এর মাঝে অবস্থিত। মোট জনসংখ্যা 1,31.757 জন। পুরুষ: 63,973 জন,মহিলা: 63,575 জন। সীমানা নিকলী উপজেলার উত্তরে করিমগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণে বাজিতপুর উপজেলা, পূর্বে মিঠামইন উপজেলা ও পশ্চিমে কটিয়াদী উপজেলার অবস্থান রয়েছে।

৩। নামকরণ:

মোগল  বাহিনী খাজা ওসমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এবং তাকে ধাবিত করতে এই এলাকায় এসে

 পৌঁছায় এবং সেখানে ছাউনি ফেলে। তাদের অস্থায়ী আবাসস্থল স্থানীয় মানুষেরা জড়ো হলে দলের প্রধান সিপাহীদের বলেন উছলে নিকালো। এই ফার্সিয় শব্দ ভাষা ‍উচ্চারনের বিবর্তন আর বিকৃতীতে নিকালো থেকে নিকলী হয়েছে  বলে জনশ্রুতি হয়েছে। অন্যদিকে, নিকলীর সাবেক নাম আগর সুন্দর বলে নানা গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছে। এদিকে নিকলী নিখলী নামের হুবহু শ্ব্দ উচ্চারণ ব্যবহার উল্লেখ রয়েছে বাংলা ভাষার প্রথম প্রাচীন চর্যাপদ নামক কাব্য গ্রন্থে। অনুরূপ প্রাচীন রসুল বিজয় কাব্য গ্রন্থে নিকলী›নিকলী›নিখলী শব্দ ব্যবহার উল্লেখ রয়েছে। অর্থাত জনপদ নামে নিকলী নামের সঠিক উতপত্তির কোন সন্ধান না পাওয়া গেলেও নিকলী এ শব্দ নামে দালিলি প্রমাণ পাওয়া যায়।

স্থানীয় ইতিহাস:

নিকলী কিশোরগঞ্জ জেলায় প্রাচীন জনপদ। ব্রিটিশ ভারতের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার প্রথম প্রকাশিত এবং 1783 খ্রিস্টাব্দে অংকিত ঐতিহাসিক মেজর জেমস রেনেল এর মানচিত্রে নিকলী জনপদের কথা উল্লেখ আছে। 1787 খ্রিস্টাব্দে মোট 39টি পরগনা নিয়ে যখন ময়মনসিংহ জেলা গঠিত হয় তখন নিকলী ছিল সেই বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার একটি উল্লেখযোগ্য পরগনার নাম। সে সময়ে সেই মানচিত্রের কিশোরঞ্জ নামে কোন গঞ্জ/থানা মহকুমা নামের কোনো উল্লেখ নেই। জেমস রেনেলের মানচিত্রে নিকলী পরগনার আরো যে সব স্থানের নাম উল্লেখ পাওয়া যায় তা হলো নিকলী/দামপাড়া/সিংপুর/কুরশা/গুরই/ডুবি ও মিঠামইন থানা হিসেবে এর প্রতিষ্ঠাকাল 15 আগস্ট 1823 খ্রিস্টাব্দ। অর্থা তখন কিশোরগঞ্জ নামে কোন জনপদের বা থানা অথবা মহকুমা নামকরণ সৃষ্টি হয়নি। সে সময়ে বর্তমান জেলার ভৌগলিক সীমানার মধ্যে থানার সংখ্যা ছিল মাত্র 2টি। একটি নিকলী অন্যটি বাজিতপুর। আর বৃহত্তর  ময়মনসিংহ জেলার মধ্যে থানার সংখ্যা ছিল মাত্র 12টি। এক কথায় 1823 খ্রিস্টাব্দে নিকলী থানা প্রতিষ্ঠার প্রায় 37 বছর পর কিশোরগঞ্জ নামে মহকুমার সৃষ্টি হয়েছে একই সঙ্গে থানা। থানা সৃষ্টির ইতিহাসে নিকলী বর্তমানে কিশোরগঞ্জ জেলার একটি প্রথম প্রাচীন থানার নাম। নিকলী পরগনা প্রাচীন থানা বর্তমান উপজেলার ভূমি রাজস্বে দ’টি অংশে বিভক্ত। একটি তপে নিকলী অন্যটি জোয়ার নিকলী নামে পরিচিত।1860 খ্রিস্টাব্দে কিশোরগঞ্জ নামে মহকুমার সৃষ্টি হয়। এর অধীনে থানার সংখ্যা ছিল মাত্র 3টি। যথা: নিকলী, বাজিতপুর ও কিশোরগঞ্জ। কিশোরগঞ্জ থানা প্রতিষ্ঠিত তারিখ উল্লেক নেই। ধারনা করা হয় একই তারিখে থানা ও মহকুমা নামের সৃষ্টি হয়েছিল। তারও বহু আগে অথ্যাৎকিশোরগঞ্জ মহকুমা সৃষ্টির প্রায় 15বছর পূর্বে নিকলী থানাকে 1845 খ্রিস্টাব্দে মহকুমা স্থাপনের জন্য একটি সরকারী প্রস্তাব ও রিপোর্ট পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কি কারণে বাস্তবায়িত হয়নি তা জানা যায়নি।  জেলা গেজেটিয়ারে এ তথ্য উল্লেখ আছে।

1880 খ্রিস্টাব্দে নিকলী থানা সদরে একটি মুন্সেফী আদালত ছিল।এটি পরবর্তীকালে হোসেনপুর থানার স্থানান্তরিত হয়। 1891 খ্রিস্টাব্দে হোসেনপুরের আদালতটি পুনরায় স্থানান্তরিত করে কিশোরগঞ্জ মহকুমা সদরে পুনস্থাপন করা হয়। 1880 খ্রিস্টাব্দে নিকলী থানা সদরে পোস্ট অফিস স্থাপিত হয়। অন্যদিকে, 1896 খ্রিস্টাব্দে নিকলী থানার পুলিশ ফাঁড়ি স্থানান্তরিত করে কটিয়াদীতে নিয়ে আসা হয়। প্রকাশ থাকে যে, কটিয়াদী সময়ে নিকলী থানার অন্তভূক্ত ছিল। অতপর: নিকলীতে পুনরায় থানা স্থাপিত হয় 1917 খ্রিস্টাব্দে। 1907 খ্রিস্টাব্দে নিকলী সদর পোস্ট অফিসে প্রাচীন টেলিগ্রাফ পদ্ধতি ও পরবর্তীকালে টেলিফোন চালু করা হয়। 1850 খ্রিস্টাব্দে নিকলী থানার প্রথম আদম শুমারীর লোক গণনার কাজ শুরু হয়। 1868 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত জেলা গেজেটিয়ার নিকলী পরগনার বিভিন্ন জনপদের বিভিন্ন ধর্মগোত্র বর্নের জনগোষ্ঠীর লোক সংখ্যা পরগনার লোক আছে। নিকলী সদরে সর্বপ্রথম বেসরকারী পর্যায়ে ভারত  চন্দ্র সাহা ডিসপেনসারী নামে একটি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান চালু হয়। বর্তমানে সরকারী পর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমম্পেক্স নামে একটি হাসপাতাল চালু রয়েছে।

 

4। ইউনিয়নসমূহের নাম: ১। নিকলী ২। দামপাড়া ৩। কারপাশা ৪। সিংপুর ৫। জারইতলা ৬। গুরই ৭। ছাতিরচর ইউনিয়ন।

৫। হাওড় সমৃদ্ধ কিশোরগঞ্জ জেলার কেন্দ্রস্থলে নিকলী উপজেলার অবস্থান। নিকলী থেকেই মূলত: হাওড়াঞ্চল শুরু হয়েছে। সে হিসেবে নিকলীকে হাওড়ের প্রবেশপথ বলা যায়। প্রবেশপথেই একেবারে হাওড়ের কুল ঘেঁসে নিকলী উপজেলা পরিষদের অবস্থান। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দয এক কথায় অপরূপ। যা নিজের চোখে না দেখলে শুধু অনুমান করা যায় না।  এখানে রয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ। মাইলের পর মাইল

শুধুই সবুজ ফসলের মাঠ। আর সে সবুজ মাঠ বৈশাখে সোনালী বরণ ধারণ  করে। ফসল তোলার পর যখন মাঠ বর্ষার পানিতে তলিয়ে যায় সে দৃশ্যটি আরো মনোমুগ্ধকর। তখন চারিদিকে শুধুই পানি আর পানি। নিকলী উপজেলা পরিষদের সামনে দাড়িয়ে পূর্বদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর পযন্ত অথৈ পানি। এ যেন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতেরেই আরেকটি সংস্করণ। হাওড়ের বিশাল ঢউ এসে আছড়ে পড়ে প্রায় 5কিমি: দীর্ঘ নিকলী উপজেলা সদর প্রতিরক্ষণ দেয়ালে। প্রকৃতি এখানে তার অপরূপ সৌন্দয মেলে ধরেছে।

 

নৌকা বাইচ নিকলী উপজেলা একটি বার্ষিক ইতিহ্যবাহী বিনোদন। লক্ষ লক্ষ লোক বর্ষকালীন নৌকা বাইচ দেখা এবং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য অপক্ষেমান থাকে। জাতীয়ভাবে সাতার প্রতিযোগিতা এবং সাতর তৈরীতেও নিকলীর ইতিহ্য অনেকদিনের। অতি সাধারণ জীবন যাপনে তুষ্ট সরল মনের মানুষ এবং দলমত নির্বিশেষে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিকলীর সবচেয়ে  বড় ঐতিহ্য।

 

৬। জনপদ ও সমাজ সংস্কৃতি:

মানব বসতির সূচনা লগ্ন থেকেই এখানে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠরি সংমিশ্রনে এক অভিন্ন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এককালে প্রাচীন কোন জনগোষ্ঠীর কোচ, গারো, হাজং প্রভৃতি জাতি গোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করতো। এমনকি এক সময় ব্যপকভাবে ভাগ্যান্বষী মানুষের আগমন ঘটেছিল এখানে। তাদের ভাষা সংস্কৃতিকে এখানকার আজকের উন্নত আধুনিক সমাজ সংস্কৃতি। বর্তমানে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ই অদ্যবধি পাশাপাশি পাড়া, গাঁ গ্রাম, বসতি স্থাপন করে অবস্থানের মাধ্যমে পারস্পরিক সুখ-দু:খ সৌহার্দ ও সম্প্রীতি বজায় রেখে সমাজ কাঠামো ও সমাজ বিন্যাস বজায় রেখেছে। নৃতাত্বিক গবেষণায় বর্তমানে হিন্দু জেলে, কৈবত, দাস,বর্মণ  কামার, কুমার পাল, ধুপ, শীল সাহা, নম, নমশুদ্র, চাড়াল, চন্ডাল, চামার, সূত্রধর, বণিক ইত্যাদি ছাড়াও মুসলিম খানদানি খন্দকার, ভূইয়া, খান, পাঠান, সৈয়দ, কারার, শেখ, মিয়া, বেপারী, প্রধানী ইত্যাদি পারিবারিক পদবীযুক্ত সামাজিক শ্রেণী সম্প্রদায় বসবাস করেন। হিন্দু মুসলিম উভয় শ্রেণীর ব্রিটিশ আমলে নামের পূর্বে শ্রী/শ্রীশ্রী/শ্রীযুক্ত ব্যবহার করার রীতি ছিল। এমনকি হিন্দু বাবুরাও নামের পুর্বে মুন্সী পদবী ব্যবহার করতেন। বর্তমান যুগে এ প্রথার প্রচলন নেই। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ে নামের পূর্বে শ্রী/শ্রীশ্রী/শ্রীযুক্ত ব্যবহার করলেও মুসলমানরা নামের পূর্বে মুহাম্মদ, মোহাম্মদ, মো:, মু-শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। বর্তমানে এখানে আধিবাসী নেই। এককালে ছিল এর বড় প্রমাণ এখানে মোহরকোনা একটি জনপদের নাম রয়েছে সাওতলভিটা। অপর আরো কয়েকটি স্থানের নাম করণ রয়েছে বৈদ্যার কান্দা, কোচের ভিটা, দাসের, সিংপুর ইত্যাদি।

ভাষা ও সাহিত্য:

এখানকার আঞ্চলিক কথ্য বা লোকভাষা মৈমনসিংহ গীতিকার প্রচলিত ভাষাবলে পরিচিত। এভাষা বাংলা আঞ্চলিক লোকসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। রচনা করেছে মহ মূল্যবান লোক সাহিত্যের ইতিহাস গ্রস্থ। ফোকলোর বা লোকসাহিত্য কিংবা লোক-সংস্কৃতিকে স্থানীয় বিশেষ বিষয়গুলো দ্বারা বিভিন্ন শ্রেনীতে বিভক্ত করা যায়। যেমন: লোকগান, লোককিসসা, মেয়েলীগীত বা গান, লোকছড়া, লোকধাঁধাঁ, লোক প্রবাদ, লোকপ্রবচন, লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার, লোপক-কু-সংস্কার, কিংবদন্তী, তন্ত্র,মন্ত্র, পালাগান, কবিগান,ঘাটুগান, নৌকা বাইচের গান, সারিগান ইত্যাদি। ফোকলোর হলো পৌরানিক লোককাহীনি। গ্রাম বাংলার পল্লী লোকসমাজ তাদের মনের ভাব প্রকাশ যে সাহিত্য সৃষ্টি করে তাকেই লোকসাহিত্য বলে।এপ্রসঙ্গে মৈমনসিংহ গীতিকার কথা উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়। লোকসাহিত্য জনপ্রিয়তা ভাটি কিশোরগঞ্জ নিকলী উপজেলা হাওড় জনপদে আজও বিরাট বিশাল অবস্থান রয়েছে। এ নিকলী অঞ্চল থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছিল মাধবী মালঞ্চ কইন্যা নামের একটি প্রাচীন পালাকাব্য। এ অঞ্চলের সাহপুর নামক গ্রাম থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছিল পৈলন খা নামক প্রাচীন পালাকাব্য। এ  দু’টি পালাকাব্য বর্তমানে বাংলা একাডেমি সংগ্রহশালার গ্রন্থাগারে আজও সংরক্ষিত আছে।

 

প্রবাদ প্রবচন ধাঁধাঁ ছড়া কল্প কাহিনী কিসসা শিলুক রূপকথা লোককথা লোকবিশ্বাস লোকউৎস কিংবদন্তী ইত্যাদি লোকসাহিত্যের অন্তভূক্ত। বাংলার লোকজীবন থাকলে তার লোক-সংস্কৃতিও থাকবে। এগুলো যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলের মানুষ পালন করে লালন করে ও গ্রহণ করে। একটি দেশের একটি অঞ্চলের একটি জেলার উপজেলার মৌলিকতা ও স্বকীয়তার পরিচয় তার লোক-সংস্কৃতি দ্বারাই সম্ভব। বাংলার আঞ্চলিক সংস্কৃতি বর্তমানে তিন প্রকার। যথা: ১। নগর-সংস্কৃতি ২। লোক-সংস্কৃতি ৩। আদিম সংস্কৃতি। এ উপজেলার  লোক-সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তার বেশী। গ্রামীণ তন্ত্র-ঝাড়, যাদু, ঝাড়, ফু, বশীকরণ, কবজ, তাবিজ, জ্বীন, পরীর চিকিৎসা, পীর-ফকির, পদ্ধতি ইত্যাদি লোক-সংস্কৃতির বিশেষ বিভাগ। যা কিছুকাল আগে পযন্ত পল্লীর এরূপই ছিল।